Commandité

বাংলাদেশে সোনার দাম বেশি কেন এবং কারণ কি?

আর্থসামাজিক ও বিভিন্ন কারণে মানুষ সোনার গয়না কিনতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েছেন মধ্য ও নিম্নবিত্তের ক্রেতাগন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরাও বলছেন, সোনার গয়না বিক্রি কমে গেছে।

বাংলাদেশে সোনার দাম কত হবে, এটা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সংগঠনটির নেতারা বিভিন্ন সময় বলেছেন, বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁরা দেশের দামঠিক করেন। কয়েক দিন পরপরই নতুন দাম ঘোষণা করা হয়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববাজারের চেয়ে দেশের বাজারে সোনার দাম অনেকটা বেশি। যেমন দুবাই জুয়েলারি গ্রুপ নামে জুয়েলার্স সমিতির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৪মে ২০২৫ এ ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ছিল ৪ হাজার ২১৭ দিরহাম, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। ভারতের বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া দর বলছে, দেশটিতে সোনার গয়নার দোকান প্রতি ভরি দর ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৯৫৯ রুপি। অর্থাৎ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৮ টাকা।

দেখা যাচ্ছে, দুবাইয়ের চেয়ে বাংলাদেশে সোনার দর প্রায় ভরিতে সাড়ে ২৯ হাজার টাকা এবং ভারতের চেয়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেশি। উল্লেখ্য, সোনার যে দাম দুবাই ও ভারতের দোকানগুলোতে নির্ধারিত রয়েছে, তার সঙ্গে অলংকার তৈরির মজুরি ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) যুক্ত হবে। বাংলাদেশেও ভ্যাট ও মজুরি যোগ হয়।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানি হয় না বললেই চলে। সোনা আসে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাতে। ‘যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা, ২০১৬-এর অনুযায়ী, একজন যাত্রী বিদেশ থেকে আসার সময় ভরিপ্রতি ৪ হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে ১০ ভরির মতো (১১৭ গ্রাম) সোনা আনতে পারেন। ভরিপ্রতি চার হাজার টাকা শুল্ক ধরার পরও দেখা যায়, বাংলাদেশে সোনার দাম বেশি। যদিও দেশে অবশ্য অবৈধ পথেই বেশির ভাগ সোনা আসে বলে সন্দেহ করা হয়। চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হয় পুরোনো সোনা দিয়ে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেজাবি (খাঁটি) সোনার দামের সঙ্গে অল্প কিছু মুনাফা যোগ করে জুয়েলারির সোনার দর নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আমরা একই পদ্ধতিতে সোনার দাম নির্ধারণ করেছি। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকার, ব্যবসায়ী অনেকেই যুক্ত।’ তিনি বলেন, সোনা বেচাকেনায় ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ চালু করলে অন্য দেশের সঙ্গে দামের তফাত কমে আসবে।

কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে শেয়ারের মতো পণ্য কেনাবেচা হয়। পণ্য সরাসরি নয়, কাগুজে বা ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কেনাবেচা করা হয়। আর মূল পণ্য থাকে কোনো গুদামে বা মাঠে। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বা হস্তান্তর হয়।

দাম বেড়ে হয়েছে ৯৯৩ গুণ

দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সোনার ভরি ছিল মাত্র ১৭০ টাকা। তারপরের পাঁচ দশকে সোনার দাম হু হু করে  বেড়ে হয়েছে ৯৯৩ গুণ। এখন এক ভরি সোনার দর এখন ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৬ টাকা। তবে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৫ এ কয়েক ঘণ্টা দাম ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা, যা দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দর।

দাম বেশি বেড়েছে বিগত আড়াই দশকে। জুয়েলার্স সমিতির তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সালে ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ছিল ৬ হাজার ৯০০ টাকা। পরের পাঁচ বছরে সেটি দ্বিগুণ হয়। ২০১০ সালের সোনার দাম তিন গুণ বেড়ে হয় ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দাম খুব একটা না বাড়লেও তার পরের পাঁচ বছরে ভরিপ্রতি ২৬ হাজার ৮৫২ টাকা বেড়ে যায়।

সোনার দর কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, জানতে চাইলে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, নতুন করে পরিস্থিতির অবনতি না হলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দাম কমার পূর্বাভাস দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

কেন দাম বাড়ে

বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সোনার দামের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে মূল্যবৃদ্ধি। কারণ, অস্থির সময়ে বিভিন্ন দেশ সোনায় বিনিয়োগ করে। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটিই ছিল তত দিন ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসের শুরুতে বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তখন সোনার দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। নতুন দর ওঠে আউন্সপ্রতি সাড়ে তিন হাজার ডলারে। তখন মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান পূর্বাভাস দিয়েছিল, আগামী বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রতি আউন্স সোনার দাম চার হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অবশ্য চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উত্তেজনা এখন কিছুটা কমেছে। তারপরই সোনার দাম কমতে শুরু করে।

সোনার দামের সঙ্গে চাহিদা ও জোগানের সম্পর্কও আছে। আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, গত বছর বিশ্বে সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশের বাজার খুবই ছোট। এখানে সুনির্দিষ্ট হিসাবও নেই। তবে মনে করা হয়, দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পুরোনো অলংকার দিয়ে। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় ও অবৈধ পথে বিদেশ থেকে আসে। বাংলাদেশ থেকে সোনা ভারতে পাচারও হয়।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হিসাবে, সংস্থা দুটি গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ১৪৩ কেজি অবৈধ সোনা উদ্ধার করেছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৯৬ কোটি টাকার বেশি।

সোনা আমদানি প্রায় বন্ধ

দেশে সোনার ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। শুরুতে একাধিক প্রতিষ্ঠান কয়েকটি চালানে সোনা আমদানি করেছিল। পরে সেখানে ভাটা পড়ে।

জানা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, অনুমতি পেতে সময়ক্ষেপণ ও ভ্যাটের কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আনার সুযোগ কমিয়ে অর্ধেক করা হয় (২৩৪ গ্রাম থেকে কমিয়ে ১১৭ গ্রাম)। পাশাপাশি ভরিপ্রতি শুল্ক দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়।

সোনা আমদানির লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জুয়েলারি হাউসের স্বত্বাধিকারী রিপনুল ইসলাম গত ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পাইকারি কেনাবেচার ক্ষেত্রে খাঁটি সোনার ভরি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করলে খরচ পড়বে ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। এ কারণে বৈধভাবে বাণিজ্যিক আমদানি হয় না।

সোনার দাম নাগালের বাইরে, বিক্রি কমেছে

বাংলাদেশে বিয়েতে সোনার গয়না উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। এ কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোকে বাধ্য হয়ে সোনা কিনতে হয়। অনেকে সোনার গয়না পছন্দ করেন, শখের বসে কেনেন। তবে এখন সোনার গয়না নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। বিক্রেতারা বলছেন, সাধারণ ক্রেতারা সোনার গয়না কেনা কমিয়েছেন।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে ১১৫টি জুয়েলারি দোকান রয়েছে। সেখানকার রূপসাগর জুয়েলার্সের বিক্রয়কর্মী যতন ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, সোনার দাম অনেক বেশি। তাই বেচাকেনা কম।

কেনার বদলে অনেকে সোনার গয়না বিক্রি করছেন বলে জানান জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, আগে কেনা গয়না এখন বেশি দামে বিক্রি করা যাচ্ছে।

ধরুন, আপনি পাঁচ বছর আগে ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকায় কিনেছিলেন। এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাবেন। তাতে ভরিতে আপনার লাভ হবে ৭০ হাজার টাকা। উল্লেখ্য, গয়না বিক্রি করতে গেলে বর্তমান ওজন থেকে ১৭ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সোনার বাজার থেকে রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ। চোরাচালান ও মাদক পাচারের লেনদেনে সোনা ব্যবহার হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের সোনার বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা দামি এই ধাতুর সরবরাহ ব্যবস্থা অনানুষ্ঠানিক। বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে সোনার দাম ওঠানামা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জুয়েলার্স সমিতির সোনার দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়াটিতে অস্বচ্ছতা রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোনার বাজারে সুশাসন ফেরাতে সরকারকে নজরদারি করতে হবে। ব্যবসাকে আনুষ্ঠানিক করার প্রয়োজনীয় সবকিছু করা দরকার।

Love
1
Commandité
Mise à niveau vers Pro
Choisissez le forfait qui vous convient
Lire la suite