Sponsorluk
আমাদের গ্রাম - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

গ্রামের শোভা / গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ / তোমার গ্রাম / নিজ গ্রামের প্রতি ভালোবাসা
ভূমিকা :
‘বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালবেসে,
ভাসানের গান শুনে কতবার ঘর আর খড় গেল ভেসে।
মাথুরের পালা বেঁধে কতবার ফাঁকা হল খড় আর ঘর।’
---- জীবনান্দ দাশ।
এদেশ গানের দেশ, কবিতার দেশ, সবুজের দেশ। বাংলার নিসর্গ ছবি, গাছের ফুল, শ্যামল প্রকৃতি, ফসলের মাঠ, পাখির কল-কাকলী, রাখালের সুরধ্বনি, নদীর কলতান, মেঠো পথ প্রভৃতি মানুষকে মুদ্ধ করে; কবির মনে দোলা দেয়। গ্রামে স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা আছে, আছে সৌন্দর্য শ্যামলিমা, আছে সরল প্রাণের চঞ্চলতা। কবির ভাষায়-
‘আমাদের দেশের রাঙা মাটির
আকুল করা ঘ্রাণ
ছুটিয়ে নেয় গাঁয়ের পথে
ভরিয়ে দিতে প্রাণ।’
আবহমান গ্রামবাংলা : গ্রামের আম-জাম-কাঁঠালের ছায়া সুনিবিড় পথে বাউল মন উদাস হয়ে ফেরে। এখানে যেন চিরন্তন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ মেলে। তার অবারিত প্রসন্ন আকাশ, দিগন্তশায়ী শস্য-প্রান্তর, দোয়েল-খঞ্জনা-শালিক-বউকথাকও পাখির কল-কূজন যেন এক স্বপ্নালোকের ইন্দ্রজাল রচনা করে দেয়। তার বনের পত্র-মর্মরে এবং স্নেহশালিনী নদীর কলগুঞ্জনে, মায়ের স্নেহ-সম্ভাষণের মতো যেন জড়িয়ে আছে এক মায়াময় স্নিগ্ধ রূপশ্রী।
গ্রামের আকর্ষণ : চারদিকে দিগন্তশায়ী বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঝখানে সবুজ দ্বীপের মতো স্বপনমাখা একখানি গ্রাম। প্রভাত-কাকলির মধ্যে প্রতিদিন উঠে আসে রক্তিম সূর্য। গরু-চরা মাঠ এবং প্রসন্ন আকাশ পূর্ণ করে বাজতে থাকে রাখালিয়া বাঁশি। আঁকাবাঁকা মেঠোপথে হেঁটে আসে নিঃসঙ্গ পথিক। আম-কাঁঠাল-নিম-অর্জুন-শিরিষের ছায়া, দীঘির কলমী লতা, বনতুলসী-ভুটফুলের ব্যাকুল ঘ্রাণ আর দোয়েল-শ্যামা-শালিক-খঞ্জনার কল-কাকলি তাকে গ্রামের অন্তপুরে আমন্ত্রণ জানায়। পথের দু’ধারে তরুশাখা পেলব বাহুতে পথিকের গলা জড়িয়ে প্রশ্ন শুধায়।
‘হে বন্ধু, আছ তো ভালো?’
গ্রামের সৌন্দর্য : গ্রামের পল্লবঘন আম্রকানন, তার রাখালের স্বপ্নময় খেলা, আর স্তব্ধ-অতল দীঘি-কালোজলের নিশীথ-শীতল স্নেহ বাঙালীর সম্মুখে রূপময় অন্তরলোকের আনন্দ-দুয়ার যেন খুলে দেয়। তার শাপলা-দীঘিতে হাঁসেরা খেলা করে। ঝুলন্ত সজিনার ডালে বকের ধ্যানমগ্নতায়, হিজল-ডালে মাছরাঙার মৎস্য তপস্যায়, ঘুঘুর কান্নায়, শঙ্খচিলের মর্ম-বিদারী আর্ত বিলাপে, ধীর প্রবাহিনী নদীর কল-গুঞ্জনে, তার আজানের ডাকে সৌন্দর্য-ভিখারী মনটি চুরি হয়ে যায়। আর এজন্যই কবি জীবনান্দ দাশ বলেছেন-
‘তোমার যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাবো।’
গ্রামের কর্মব্যস্ততার রূপ : গ্রামের চাষীরা হাল-বলদ নিয়ে মাঠে চাষে, বীজ বোনে, পাকা ফসল তোলে। জেলেরা মাঝ ধরে, কুমারেরা হাঁড়ি-কলসী তৈরি করে, কামারেরা লোহার জিনিসপত্র বানায়, তাঁতী তাঁত বোনে। আর গ্রামের মেয়েরা নৃত্যময় ছন্দে ঢেঁকিতে ধান ভোনে। এইভাবে গ্রামের জীবন-ছন্দ প্রতিদিন বিচিত্র ভঙিতে বিকশিত হয়ে ওঠে।
গ্রামের অর্থনৈতিক জীবন : গ্রামের অর্থনৈতিক জীবন স্বচ্ছল নয়। কিন্তু একটি আশ্চর্য আত্মতৃপ্তির ভাব লেগে আছে গ্রামের অধিবাসীদের চোখেমুখে। দৈন্য আছে, অভাব-অনটন আছে, আছে রোগতাপের জ্বালা। কিন্তু তাই-ই সব নয়। আর্থিক অস্বচ্ছন্দ্যের ওপরে মুখর হয়ে ওঠে এক অপরাজেয় প্রাণ-প্রাচুর্য। হাট তার বিনিময় কেন্দ্র। মহাজন ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা গ্রামের পণ্য-সম্ভার দূরে শহরে, গঞ্জে কিংবা রেল-স্টেশনে চালান দেয়। গ্রামের সকলের প্রচুর পরিমাণে জমিজমা নেই। যা আছে তা দিয়েই কিংবা বর্গা-চাষ কায়ক্লেশে দিনপাত করে।
গ্রামের সাংস্কৃতিক জীবন : যুগ যুগ ধরে পূজা-পার্বণ ও উৎসব-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গ্রামের সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হয়ে উঠেছে। ঈদ, নানা পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান, নববর্ষ, মেলা ইত্যাদি উৎসব তো তার লেগেই আছে।
গ্রামের অতীত ও বর্তমান : হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজল-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ- যার মূলভিত্তি ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো’। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম (বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী) নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৮৫ জন লোক পল্লীগ্রামে বাস করে। পল্লীর সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল,
‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’
কিন্তু পল্লীর সে-সৌন্দর্য এখন আর দেখা যায় না, আমাদের অবহেলার কারণে পল্লীগ্রামগুলো আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ কেবলই –
‘ইটের পর ইট মাঝে মানুষ কীট, নেইকো ভালোবাসা নেইকো মায়া’
এমনি কৃত্রিম সুখের অন্বেষণে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ কৃষিনির্ভর এই দেশের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়, যদি না গ্রামের উন্নয়ন হয়। গ্রামের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি।
প্রাচীন-পল্লী :
‘চাষী ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার।
তারি ‘পরে ভার দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’
---- রবীন্দ্রনাথ।
-প্রাচীন পল্লীর এই ছিল রূপ। আদিকাল থেকেই পল্লীগ্রাম ছিল দেশের প্রাণকেন্দ্র। পল্লীবাসী মানুষের ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ, গলায় গলায় গানের সুর, কুটিরশিল্পের প্রচলন। ঢাকার মসলিন কাপড় ও জামদানি শাড়ি তৎকালীন মোগল বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কুমিল্লার হুক্কা ও খদ্দর-কাপড়, ময়নামতির ছিট কাপড়, পল্লীর নকশীকাঁথাও তৎকালীন ঐতিহ্য বহন করেছিল।
বর্তমান-পল্লী :
‘বড় দুঃখ, বড় ব্যথা সম্মুখেতে কষ্টের সংসার,
বড়ই দরিদ্র, বড় শূন্য, বড় ক্ষুদ্র, বড় অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উচ্ছল পরমায়ু’
কবি রবীন্দ্রনাথের এই আবেদন-নিবেদনেই ধরা পড়ে যে, পল্লীর অতীত ঐতিহ্য এখন আর নেই। পল্লীর আনন্দ-উৎসব, সুখ-শান্তি সব হারিয়ে শ্রীহীন হয়েছে। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, গলাভরা গান, মাঠে প্রান্তরে রাখালের বাঁশির সুর এখন আর শোনা যাচ্ছে না। দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অনটন, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় পল্লীবাসী জর্জরিত। নেই শিল্পের প্রসার, অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান। চতুর্দিকে শুধু ধ্বংসের প্রলয়বীণা ধ্বনিত হচ্ছে। শান্তি-নীড় ভেঙে পল্লী অশান্তির পিঞ্জরে পরিণত হয়েছে। তাই কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
‘সোনার বাংলা-
সোনার বাংলা-কবিকল্পনা তার-
দিকে দিকে শুধু ক্ষধিতের হাহাকার।’
-এমনি করে গ্রামবাসী বিলীন হয়ে যাচ্ছে দুর্দশার প্রগাঢ় অন্ধকারে।
‘God made the country, man made the town’
অথচ বিধাতার এই গ্রামকে দেখার মতো আজ যেন কেউ নেই।
উপসংহার : গ্রাম হল “ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়”। স্বাধীনতার পর তিনটি দশকে গ্রামের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যাপক ও সার্বিক কোনো কার্যক্রম গৃহীত হয় নি। ফলে বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মূল উৎস গ্রাম। গ্রামের উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সর্বমুখী ও সর্বজনীন কল্যাণ সম্ভব নয়। গ্রামের অবস্থান ও উন্নয়নের উপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। তাই গ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে।
