Спонсоры

একটি ঝড়ের রাত – বাংলা প্রবন্ধ রচনা - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

উপস্থাপনা  

প্রকৃতি যেমনিভাবে মানুষকে আনন্দ ও সুখ-শান্তি দিয়ে থাকে, তেমনিভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে তাদের কপালে দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশার চিহ্নও এঁকে দেয়। এ দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঝড় অন্যতম। 

প্রায় প্রতিবছরই ঝড় এ দেশের মানুষের ওপর বিভীষিকাময় আক্রমণ চালায়। এমনি শত-সহস্র ঝড়ের মধ্যে আমার জীবনেও বিচিত্র এক ঝড়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিম্নে সেটি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হলো ।

ভৌগোলিক প্রভাব  

ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে ঝড়-বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহরূপ ধারণ করে। প্রায় প্রতিবছরই এ কারণে ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি ঘটে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ দেশে নানা প্রতিকূল অবস্থার সাথে সংগ্রাম করে আমাদেরকে টিকে থাকতে হয়। ঝড়-তুফান কত দম্পতির সাজানো সংসার তছনছ করে দেয়, কত প্রিয়জনকে কেড়ে নেয়, তার কোনো হিসাব নেই।

ঘটনার বিবরণ  

তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসার আলিমের ছাত্র ছিলাম তখন। কয়েকজন বন্ধু মিলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁসে জেগে ওঠা কুতুবদিয়া দ্বীপে বেড়াতে গেলাম । একটি বাড়িতে আমাদের থাকার জায়গা হলো । যেখান থেকে সমুদ্রবক্ষের তরঙ্গায়িত জলরাশি এবং অন্তহীন সমুদ্রের দিকচক্রবাল অবলোকন করে আনন্দে যেমন সময় কাটছিল, তেমনি এক রাতের ঝড় আমাদের সব আনন্দ ম্লান করে দিয়ে স্মৃতিপটে এক দুঃসহ দৃশ্য এঁকে দিয়েছে।

ঝড়ের পূর্বাভাস  

তখন ছিল কার্তিক মাস। সকাল থেকেই আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। সমগ্র প্রকৃতির মুখে কেমন একটি বিষণ্ণ গাম্ভীর্য। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেল, চারদিকে এলোমেলো বাতাস বইছে। প্রকৃতি কেমন যেন বিরূপ আকার ধারণ করল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রেডিওতে বিপদ সংকেত ঘোষণা করা হচ্ছে।

ঝড়ের আগমন  

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই প্রকৃতিলোকে অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা গেল । বাতাসের তীব্র গতিবেগসহ ঘনকৃষ্ণ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুতগতিতে ছুটে আসতে লাগল । সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম ঝড়ো হাওয়ার একটানা শোঁ শোঁ শব্দ ও ক্ষুব্ধ ঝটিকার উত্তাল গর্জন। প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎত্বহ্নি ঝলসিত হয়ে গোটা আকাশটাকে বিদীর্ণ করে দিতে চাইল । চারদিকে জমাটবাঁধা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শুধু কেবল ভেসে আসছিল আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার ।

ঝড়ের ভয়াবহতা  

ঝড়ের প্রচণ্ড প্রকোপে আমরা ঘরে আশ্রয় নিলাম। ঝড়ের তীব্র ঝাঁপটায় জানালা-দরজা কেঁপে উঠতে লাগল । দুর্বার শক্তিতে এক বিপুলাকার দানব যেন বাড়িটার ঝুটি ধরে নাড়া দিচ্ছে। বাড়ির আশপাশের গাছগুলো শিকল বাঁধা আহত অতিকায় পাখির মতো ছটফট করছে। আকাশ, সমুদ্র, পৃথিবী অন্ধকারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে প্রকাণ্ড মূর্তি ধারণ করেছে। 

প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে আমাদের ঘরের জানালার কপাট খুলে পড়ল। আচমকা ধাক্কায় মাথার উপর থেকে কয়েকটি টিন মুহূর্তে অন্ধকারে হারিয়ে গেল । আমরা সবাই মৃত্যুর প্রহর গুণতে লাগলাম । হঠাৎ করে বাড়িটার ভৃত্যের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম । তার ডাকে কোনোরকমে একজন আরেকজনকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম ।

বজ্র, বিদ্যুৎ, বৃষ্টিধারা সবকিছু উপেক্ষা করে একটি আশ্রয় কেন্দ্রের বারান্দায় এসে উঠলাম। মুহূর্তেই দূরের বাড়িঘরে রক্তবর্ণ একটি অদ্ভুত বাতি জ্বলে উঠল। ভয়াবহ বিপদ অনুভব করলাম। আমার হৃদয়ের ভেতরে আরেকটি ঝড় উঠল, সমুদ্রের মহা প্রলয়ঙ্করী দৃশ্য দেখার সাহস, ধৈর্য সব হারিয়ে চোখ বুঝলাম । 

ঝড়-পরবর্তী অবস্থা  

ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডবে জ্ঞান হারিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রের বারান্দায় হিম হয়ে পড়েছিলাম। ভৃত্যের ডাকে চোখ খুলে দেখলাম, ঝড় থেমে গেছে, তবে সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ গোঙানি এখনো থামেনি। আকাশে সূর্য, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উঁকি দিচ্ছে। বাইরে বের হয়ে এলাম। বাইরে অবর্ণনীয় বীভৎস দৃশ্য। মাঠেঘাটে শত শত গরু, মেষ, ছাগলের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। 

তীর ঘেঁষে কতগুলো ভাঙা নৌকা ও জেলেদের লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে। চরের অসংখ্য মানুষ তাদের আপনজনদের সন্ধান না পেয়ে অসহায় দৃষ্টিতে সর্বগ্রাসী সমুদ্রের পানে চেয়ে আছে। কী অসহায় তাদের দৃষ্টি, কী মর্মভেদী তাদের বুকফাটা ক্রন্দন। স্বজনহারাদের আর্তচিৎকারে সেদিন কুতুবদিয়ার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল।

ঝড়ের রাতের অভিজ্ঞতা  

প্রকৃতি কতখানি নিষ্ঠুর, কতখানি ভয়ঙ্কর হতে পারে আগে তা জানতে পারিনি, সেই ভয়াল রাতে ঝড়ের সর্ববিধ্বংসী রূপ প্রত্যক্ষ করলাম, উপলব্ধি করলাম ঝড়ের তাণ্ডব কত মারাত্মক।

উপসংহার  

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ঝড়ের তাণ্ডবলীলার কথা শুনেছি। কিন্তু কুতুবদিয়ায় গিয়ে ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছি। ঝড় থেমে গেছে, সমুদ্র শান্ত হয়েছে। রোদের মুখে প্রকৃতি আবার হেসে উঠেছে; কিন্তু সেই বিভীষিকাময় ঝড়ের রাতটির কথা আমার স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি ।

Спонсоры
Обновить до Про
Выберите подходящий план
Больше