Sponsor

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা : আধুনিক যুগে পৃথিবীতে সভ্যতা বিস্তার ও অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে যাতায়াত ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কোন দেশের প্রভূত উন্নয়নের মূলে রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া কোন দেশই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নতি করতে পারে না। কোন একটি দেশের সম্ভাব্য উৎপাদন, বণ্টন, মূল্য নির্ধারণ, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
 
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা-
(ক) জলপথ
(খ) স্থল পথ এবং
(গ) আকাশ পথ।
 
(ক) জলপথ : বাংলাদেশে দুই ধরনের জলপথ রয়েছে। যথা-
(১) নদী ও খালপথ এবং
(২) উপকূলীয় সমুদ্রপথ।
 
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নদীপথের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। নদীপথে সাধারণত নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করে। বাংলাদেশে প্রায় ৮,৪০০ কি. মি. দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ নাব্য জলপথ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫,৪০০ কি. মি. সারাবছর নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। অবশিষ্ট প্রায় ৩,০০০ কি. মি. কেবল বর্ষাকালে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে নদীপথে ছোট ছোট নৌকা থেকে শুরু করে লঞ্চ-স্টিমার, সী-ট্রাক, ট্যাঙ্কার, কোস্টার, ফেরী, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রভৃতি চলাচল করে।
 
বাংলাদেশের ‍গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরগুলো হচ্ছে- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি ও খুলনা। অন্যান্য নদীবন্দরের মধ্যে ভৈরব বাজার, আশুগঞ্জ, মীরকাদিম, গোয়ালন্দ ও সিরাজগঞ্জের নাম উল্লেখযোগ্য।
 
বাংলাদেশের নদীপথগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নদীপথের গুরুত্ব ব্যাপক। নদীমাতৃক এদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি বড় ও ছোট নদীগুলো সারাবছর নাব্য থাকে যার ফলে নৌ পথেই যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়। পরিবহণ ব্যবস্থার মধ্যে নৌপথ খুবই সুলভ। ভারী পণ্য পরিবহণে নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নৌপথে খুব সহজেই খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল শহরাঞ্চলে প্রেরণ করা যায়। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ আহরণে নদীপথের গুরুত্ব রয়েছে। নৌপরিবহণের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত থেকে বহু লোক জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
 
(খ) স্থলপথ : স্থলপথ বলতে বোঝায় সড়কপথ ও রেলপথ। সড়কপথে যাতায়তের যানবাহন হল বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি, মোটর সাইকেল, রিক্সা, সাইকেল, অটোরিক্সা ইত্যাদি। রেলপথে রেলগাড়িই একমাত্র বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সড়ক পথের পরিমাণ ছিল ৩৮,৬২৩.৪৫ কিলোমিটার। ১৯৯৬-৯৭ সালের তথ্যানুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে মোট সড়ক পথের দৈর্ঘ্য ১,৭৮,৮৫৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে- পাকা রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ১১,৩৯৩ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তার দৈর্ঘ্য ১,৬৭,৪৬৬ কিলোমিটার (উৎস : পরিসংখ্যান পকেট বই, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সারণি ৮.০৩)
 
রেলপথ : বাংলাদেশে রেলপথ একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রেলপথের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশে রেলপথের পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৮৫৭ কিলোমিটার। ১৯৯৫-৯৬ সালে ২,৭০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ২,৭৩৩.৫১ কিলোমিটার রেলপথ আছে। (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০০, সারণি ৩৭, পৃ: ১৬৭) এটি ‘বাংলাদেশ রেলপথ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে দুইপ্রকার রেলপথ রয়েছে। যথা- (ক) ব্রডগেজ ও (খ) মিটারগেজ
 
বাংলাদেশে ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রায় ৮৮৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ৯০১.০৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ আছে। এ প্রকারের রেলপথ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। তবে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর ও রাজবাড়ি জেলায় সামান্য ব্রডগেজ রেলপথ আছে।
 
১৯৯৫-৯৬ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১,৮২২ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ছিল। ১৯৯৮-৯৯ সালোর তথ্যানুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশে ১,৮৩২.৪২ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ আছে। যা যমুনা নদী দ্বারা দুইভাগে বিভক্ত। পূর্বভাগে সম্পূর্ণ মিটারগেজ রেলপথ, পশ্চিমভাগে ৯০১.০৯ কি. মি. ব্রডগেজ এবং অবশিষ্টাংশ মিটারগেজ। বাংলাদেশ রেলপথের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে তিস্তামুখ ঘাটে বা বাহাদুরাবাদ এবং সিরাজগঞ্জ ও জগন্নাথজঞ্জের মধ্যে দুটি রেলওয়ে ফেরী চালু আছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, টাঙ্গাইল, বরিশাল, পটুয়াখালি এবং বরগুনা ব্যতীত দেশের সব জেলাতেই রেলপথ আছে।
 
রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে রেলপথে যাতায়াত করা যায়। বাংলাদেশ রেলপথে সর্বমোট ৪৮৯টি রেলস্টেশন আছে। এর মধ্যে লাকসাম, আখাউড়া, ময়মনসিংহ, ভৈরব বাজার, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, শান্তাহার, বোনাপাড়া, কাউনিয়া এবং ঢাকার কমলাপুর জংশনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 
(গ) আকাশ পথ : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর দুটি শাখায় মোটামুটি উন্নয়ন ঘটলেও আকাশপথের তেমন কোন উন্নয়ন হয় নি। দেশের অর্থনৈতিক সহায়তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ বিমানপথ মূলত যাত্রী পরিবহণ করে আসছে। আকাশ পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, যশোর, ঈশ্বরদী, সৈয়দপুর ও ঠাকুরগাঁও যাতায়া করা যায়। কুর্মিটোলায় অবস্থিত ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ দেশের প্রধান বিমান বন্দর। চট্টগ্রাম শাহ আমানত ও সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরকে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান সংস্থা আন্তর্জাতিক পথে বর্তমানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করছে।
 
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার তাৎপর্য : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট অবদান রাখছে। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নে ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ কার্যকর। পণ্য আমদানি-রপ্তানী, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন উপকরণের গতিশীলতা, কাঁচামাল ক্রয় ও পণ্য বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর সরাসরি নির্ভরশীল। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাতকরণ ও বীদেশে রপ্তানীর জন্য বন্দরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে। সুষম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার বিষয়টিও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। দেশের খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলার জন্য এবং দ্রুত পণ্যসামগ্রী পরিবহণের জন্য উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূল্যবান সম্পদ আহরণের সুযোগ ঘটে উত্তম পরিবহণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্যও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ সহায়ক।
 
যোগাযোগ ব্যবস্থায় শিল্পকারখানার বিকাশ : শিল্প নীতির শিল্পে উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে স্থলপথ, জলপথ ও বিমান পথের উন্নয়ন ও সংস্কার হবার ফলে এবং বিশ্বের মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ারে দেশী ও বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্পকারাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ঢাকা অদূরে জয়দেবপুর, টুঙ্গি, গাজীপুর, তেজগাঁও, কেরাণীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন অঞ্চল দ্রুত শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম নৌবন্দর, চালনাবন্দরসহ দেশের ছোট ছোট বন্দরগুলো ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলেই। তাই যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য।
 
বাংলাদেশের পরিস্থিতি : বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়তনের দেশ। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার সব ধরনের মাধ্যম থাকলেও অর্থনৈতিক অসচ্চলতার কারণে তা এখনো ব্যাপকভিত্তিক প্রসার লাভ করে নি। এছাড়া ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এদেশে জালের মতো নদী ছড়িয়ে আছে বলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দ্রুত সম্ভব নয়। অধুনা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে দেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং এর সুফল অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে এ দেশ সম্পৃক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
 
উপসংহার : জাতীয় জীবনকে আরও গতিশীল ও স্বচ্চল করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এদেশে উন্নত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে জাতীয় জীবনে এর বহুবিধ সুফল পাওয়া সম্ভব এবং অর্থনৈতিক মুক্তিও ঘটবে দ্রুত। মোটকথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলেই দেশ ও জাতির উন্নয়ন হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
Like
2
Sponsor
Upgrade to Pro
Alege planul care ți se potrivește
Citeste mai mult