Sponsored

আকাশ সংস্কৃতি ও তার প্রভাব / স্যাটেলাইট টিভি-র ভালোমন্দ / ডিশ অ্যান্টেনা ও কেবল টিভির প্রভাব - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা : বিশ শতকের উপান্তে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বিস্ময়কর ও বৈপ্লবিক অগ্রগতি। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ ও সম্প্রচার চ্যানেলগুলোকে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে একটা পরিবারের গণ্ডির মধ্যে। ফলে ইচ্ছে করলে ঘরে বসেই আমরা দেশ-বিদেশের নানা টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রায় সার্বক্ষণিক দেখার সুযোগ পাচ্ছি। এসব অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়েছে ডিশ অ্যান্টেনা এবং কেবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা ঘটনা ও সংবাদ সম্পর্কে জানতে পারি, নানা দেশের নানা ধরনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানও উপভোগ করতে পারি। কিন্তু ইতিমধ্যেই এসব অনুষ্ঠান আমাদের সমাজজীবনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই বিপরীতধর্মী প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ফলে স্যাটেলাইট টিভি-র সুফল-কুফল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
 
স্যাটেলাইট সম্প্রচার যুগে বাংলাদেশ : ১৯৯২ সালে প্রথমে সি.এন.এন. এবং পরে বিবিসি টেলিভিশনের সঙ্গে উপগ্রহ সংযোগ দিয়ে এবং ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহারের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশে বৈদেশিক টিভি সম্প্রচারের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ঘরের ছাদের ওপর বিশালাকার ডিশ অ্যান্টেনা স্থাপন করে বৈদেশিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা প্রথম দিকে ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে এর ব্যবহারও ছিল প্রধানত বিত্তবানদের মধ্যে সীমিত। কিন্তু পরবর্তীকালে কেবল নেটওয়ার্ক তৈরি করে নির্ধারিত মাসিক ফি-র বিনিময়ে ঘরে ঘরে কেবল সংযোগ দিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন শহর অঞ্চলে, এমনকি অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখা সম্ভব হচ্ছে। এভাবে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি চালু হওয়ার ফলে তথ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, বিনোদন, খেলাধুলাসহ বৈচিত্র্যময় নানা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছেন অগণিত গ্রাহক। ঘরে বসেই বিটিভি-র অনুষ্ঠান ছাড়াও সি.এন.এন. বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, একুশে টিভি, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, জিটিভি, পিটিভি, এমটিভি, ইটিভি, জি-সিনেমা, স্টার প্লাস, স্টার মুভিজ, স্টার স্পোর্টস, ডিডি মেট্রো, ডিডি-১, ডিডি-৭, সনি টিভি, জৈন টিভি, এশিয়া মিউজিক, এএক্সএন, কার্টুন নেটওয়ার্ক প্রভৃতি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছেন। এর ফলে বিশ্বের অতি-আধুনিক নানা শিক্ষামূলক, সুস্থ বিনোদনমূলক এবং স্থূল উত্তেজনামূলক বহু বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানমালা নিত্য উদ্ভাসিত হচ্ছে ড্রইংরুমের টিভি পর্দায়। এখন অনুষ্ঠানমালা কেবল বিটিভি চ্যানেলে সীমিত নয়, রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে নম্বর টিপে ইচ্ছে মতো পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকম চ্যানেলে। তা যেমন বৈদেশিক সংস্কৃতির ও চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে তেমনি আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও উন্মুলিত হবার।
 
উপযোগিত : স্যাটেলাইট টিভি বিশ্বের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র ঘটয়েছে। বিবিসি, সি.এন.এন.-এর মতো তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের নানা প্রান্তের তথ্য ও ঘটনা সম্পর্কে মুহূর্তেই অবহিত হতে পারছি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আমাদের জানার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। এককথায় স্যাটেলাইট টিভি-র মাধ্যমে বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রচিত হচ্ছে। একুশ শতকের প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে পদক্ষেপ রাখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হতে পারছে। বিপুল ব্যয় সাপেক্ষে বিশ্ব সংস্কৃতির মহত্তম অবদানভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র ও অনুষ্ঠান আমরা এখন সহজেই ঘরে বসে উপভোগ করছি। আমাদের মতো গরিব দেশে এ সমস্ত সুযোগ এসেছে স্যাটেলাইট টিভি যোগাযোগের মাধ্যমে।
 
নেতিবাচক দিক : স্যাটেলাইট টিভি-র মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা নানাভাবে আমাদের মন ও মননের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্থূল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের উত্তেজক নেশা আমাদের পেয়ে বসছে। বিজাতীয় অনুষ্ঠান তরুণ প্রজন্মের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। তাদের চুলের স্টাইল, পোশাক, বোলচালে ইংরেজি হিন্দি বুলিসহ বিদেশিয়ানার ছাপ ফেলছে। নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতির আলাদা অস্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য ভুলিয়ে দিচ্ছে। বিরাজমান বাস্তবতাকে মোকাবেলা করার পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে কল্পনা-বিলাসিতার ঘোরে তাকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। কোনো অনুষ্ঠানে অবাস্তব, অতিপ্রাকৃতিক, কল্পনাপ্রবণ, লোমহর্ষক ঘটনা ও কাহিনী উপস্থাপিত হয়। এসব অনুষ্ঠান স্থূল যৌনতা, লোমহর্ষক খুনজখম, হানাহানিময় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। উঁচু মানের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধ তাতে ঠাঁই পায় না। আমাদের দেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিহীন এসব অনুষ্ঠান প্রচার ও উপভোগের ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত হয়তো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের রূপ নিতে যাচ্ছে।
 
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : স্যাটেলাইট টিভি যে উন্নয়নশীল দেশের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ নানা গবেষণায় তা স্পস্ট হতে শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ তুলেছে, জাপান, হংকং ও আমেরিকার স্যাটেলাইট টিভি-র প্রভাবে তাদের জাতীয় টিভি ইন্ডাস্ট্রি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে পশ্চিমা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র উচ্চ ও নিম্নবিত্ত তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের ওপর এত বেশি প্রভাব ফেলেছে যে সে দেশের সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। আমাদের দেশেও ডিশ অ্যান্টেনা চালু হওয়ার পর থেকে বিটিভি-র দর্শক কমে গেছে। আমাদের টিভিতে বিদেশী প্রভাব ক্রমশ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানছে।
 
উপসংহার : মোট কথা, স্যাটেলাইট টিভি-র কবলে পড়ে আমাদের দেশ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। এখন থেকে সচেতন না হলে স্যাটেলাইট টিভি-র প্রভাবে দেশের বর্তমান প্রজন্ম জাতির ঐতিহ্য, নিজস্ব ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ভুলতে বসবে। নিজস্ব মূল্যবোধের ক্রমিক অবক্ষয় ঘটবে। ফলে অতিরিক্ত বিদেশিয়ানা, রুচিবিকার, সস্তা জীবনমোহের আকর্ষণে তাদের মানবিক মূল্যবোধও হবে বিপর্যস্ত। তাই স্যাটেলাইট টিভি-র সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা দরকার। প্রযুক্তির নবতর সংযোজনের ক্ষেত্রে নতুন ও স্পষ্টতর আইনগত বিধিনিষেধ না থাকায় পুরনো আইনের ফাঁকফোকর গলে স্যাটেলাইট টিভি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে নতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে তা অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতির দরজা-জানালা আমরা অবশ্যই খোলা রাখতে চাই কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বস্তাপঁচা অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ আমাদের সমাজ জীবনে ছড়িয়ে পড়ুক এটা আমরা মানতে পারি না।
Like
1
Sponsored
Upgrade to Pro
Choose the Plan That's Right for You
Read More