Sponsored

কোরবানির গুরুত্ব ফজিলত ও ইতিহাস

কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশিষ্ট ইবাদত। এটি হজরত আদম আ.-এর যুগ থেকে বিদ্যমান আছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরিয়তে কোরবানির পন্থা এক ছিল না। হজরত আদম আ. এর শরিয়তে প্রচলিত কোরবানির পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের সুরা মায়িদার ২৭-৩১ নম্বর আয়াতে কিছুটা বর্ণিত আছে।

গুরুত্ব:

১. তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন: কোরবানির মাধ্যমে বান্দা-বান্দি তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং কোরবানির মধ্য দিয়ে তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারি বা আল্লাহভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছে। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন—যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা কর। এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।’ (সুরা হজ: ৩৯)

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নয়ন: কোরবানির গোশত তিন ভাগ করা মুসতাহাব। কুরবানির গোশত আত্নীয় -স্বজনদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চমৎকার রীতি মুসলিম সমাজে রয়েছে। কোরবানির মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাতায়াত নেই এরকম আত্নীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এতে আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়। ইসলামে আত্নীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। 

৩. সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা: কোরবানির গোশত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হয়ে থাকে। এতে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ বছরে অন্তত একদিন হলেও উত্তম খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়। এতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। সমাজে একটি উৎসব উৎসব আমেজ পরিলক্ষিত হয়।

৪. অর্থনৈতিক গুরুত্ব: কোরবানি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। কোরবানি উপলক্ষে খামারিরা পশু পালন করে সাবলম্বী হচ্ছে। অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হচ্ছে, অনেকেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। এমনকি অনেক শিক্ষিত যুবক এক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন।

দেশের রপ্তানি খাতের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। কোরবানির পশুর চামড়া এক্ষেত্রে দারুন ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতি বছর। মহান আল্লাহ আমাদেরকেকোরবানির গুরুত্ব অনুধাবন করার ও এর মাধ্যমে উপকৃত হবার তাওফিক দিন। আমিন।

ফজিলত :

কোরবানি শব্দটি আরবি মূলধাতু 'কুরবান’ শব্দ থেকে উৎসারিত । এর অর্থ হচ্ছে, নৈকট্য। যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই করা হয় সেহেতু এটি কোরবানি নামে অভিহিত। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরিয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে তাকে আভিধানিক দিক থেকে ‘কুরবান’ বলা হয়। হাদিস শরিফে কোরবানির অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

১. হজরত জাইদ বিন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন- একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল,এই কোরবানি কি? (অর্থাৎ এই কোরবানি কি আমাদের শরিয়তে নির্দিষ্ট হয়েছে, না পূর্বেও কোন শরিয়তে ছিল? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিমের সুন্নাত (আদর্শ)। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল, এতে আমাদের কি (সওয়াব) রয়েছে? হুজুর বললেন, কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি লোমের পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে। তারা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল, এতে আমাদের লাভ? (অর্থাৎ ভেড়ায় পশম বা লোম অনেক তার লোমের পরিমাণও কি সওয়াব দেওয়া হবে?) হুজুর বললেন, (ভেড়ার) প্রতি লোমের (পরিবর্তে) এক একটি সওয়াব রয়েছে। (আহমাদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

২. উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোরবানির দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কুরবানিকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কুরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানি কর। (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৯৩)

৩. হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার কোরবানির সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।(মুসনাদে আহমদ)

কোরবানির ইতিহাস :

হজরত আদম ও হজরত হাওয়া আ. পৃথিবীতে আসেন এবং সন্তান ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একজন পুত্র ও একজন কন্যা-এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। আল্লাহ্ তা'আলা প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.)-এর শরিয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারিণী কন্যা সহোদর বোন গণ্য হবে না। তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।

কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোনটি ছিল পরমাসুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত কন্যাটি ছিল কুশ্রী ও কদাকার। বিবাহের সময় হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত কুশ্রী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে গেল। সে জেদ ধরল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হজরত আদম (আ) তাঁর শরিয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আব্দার প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানি পেশ কর। যার কুরবানি গৃহীত হবে, সে সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করবে। হজরত আদম আ. এর নিশ্চিত বিশ্বাস যে, যে সত্য পথে আছে, তার কুরবানিই গৃহীত হবে।

ঐ সময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা অবতীর্ণ হয়ে কুরবানিকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানি অগ্নি ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো।

হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানি করল। কাবিল কৃষিকাজ করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানির জন্য পেশ করল। অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানিটিকে ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানি যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও. ক্ষোভ বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে ভাইকে বলে দিল, 'আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।' (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৩/৯৮-৯৯)

পৃথিবীতে প্রথম কোরবানি হজরত আদম আ. এর সময় থেকে প্রচলিত হলেও ইসলামি শরিয়তে কোরবানির যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তা হজরত আদম আ. থেকে আমাদের পর্যন্ত এসেছে। 

হজরত ইব্রাহিম আ. এর ৮৬ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো সন্তান হননি। তিনি আল্লাহর নিকট মোনাজাত করতেই থাকতেন। অবশেষে তাঁর বয়স যখন ৮৬ তখন তার ঔরসে হজরত ইসমাইল আ. এর জন্ম হয়। এরপর নিরানব্বই বছর বয়সে তাঁর আরো একজন সন্তান জন্মগ্রহণ করে যার নাম হজরত ইসহাক আ.। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-৯/৪৩৯)

ইব্রাহিম আ. শাম বা সিরিয়াতে বসবাস করতেন। একসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এল, পুত্র ইসমাইল ও তাঁর মা হা-জারকে যেন মক্কায় রেখে যান। মক্কায় তখন জনবসতি ও জীবনোপকরণ কিছুই ছিল না। তার পরও আল্লাহর নির্দেশমতো তিনি তাঁদেরকে সুদূর মক্কায় রেখে যান।

পুত্র যখন পিতার সঙ্গে চলাচলের বয়সে উপনীত হলো তখন আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নে হজরত ইব্রাহিম আ. কে তাঁর প্রিয় ও একমাত্র পুত্রকে কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন। হজরত ইসমাইল ইব্রাহিম আ. নিজ স্বপ্নের কথা সন্তানকে জানিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন- হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন- হে আমার পিতা, আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। (সূরা সাফফাত- ১০২)

এরপর আল্লাহ বলেন, অতঃপর যখন তারা উভয়ে আদেশ মান্য করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিল। আর আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা এবং আমি এক মহান কোরবানির (পশুর) বিনিময়ে তাকে (ইসমাইল) মুক্ত করলাম। (সূরা সাফফাত ১০৩-১০৭)

ইব্রাহিম আ.-এর এই দুম্বা কোরবানি হল, ইসলামি শরিয়ার নির্দেশিত কোরবানির পদ্ধতির মূল সূত্র। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- সুতরাং আপনার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন। (সূরা কাওসার-২)

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে নামাজ ও কোরবানির আদেশ দিয়েছেন।

কোরবানি কাদের উপরে ওয়াজিব :

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নেসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (আল কাউসার, সেপ্টেম্বর ২০১৭)

অর্থাৎ কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানির তিন দিন থাকলে এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের কিছু আগে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলেও কুরবানি ওয়াজিব হবে।

Love
1
Sponsored
Upgrade to Pro
Choose the Plan That's Right for You
Read More